বঙ্গ নারীর স্বতন্ত্র "মিশর ভ্রমণ" - পর্ব ১

আমি বড় অলস মহিলা। শখের বেলায়। আমার কোনো বাকেট লিস্ট নেই। নেই কোনো চিরচারিত বাঙালিময় সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। এহেন আমিই টপাত করে ঘুরে এলাম শিহরণ উদ্রেককারী দেশ মিশর। কিভাবে এলো মাথায় এই মিশরের কথা? স্রেফ ফেসবুকে অলস সময় কাটাতে যেয়ে হঠাৎ ফ্লাই ফার লেডিস নামে এক মহিলা ভ্রমণকারী পেজের পোস্ট দেখে। তখন মাত্র তিন মাস আগে চীন ঘুরে এলাম। হাতে তেমন টাকা পয়সাও ছিল না। শুয়ে বসে জমানো টাকা ভাঙছিলাম। হঠাৎ মনে হলো যাই ঘুরে আসি, হাতে মাস পাঁচেক সময় আছে টাকা কামানোর। কারণ মিশরের এই ট্রিপটা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। এর পর গুরুত্ব সহকারে সিভি ফেলা শুরু করলাম আর তার পর চাকরি পেয়ে প্রথম মাসের বেতন দিয়ে বুকিং করে এলাম। এর পর পাঁচ মাস যেতে অনেক সময় লাগলো। আমরা ২৩ জন বিভিন্ন বয়সের বাঙালী মেয়ে বা মহিলা ২০শে ফেব্রুয়ারি ভোর রাত ১:৫৫ মিনিটে সৌদি এয়ারলাইন্স এ যাত্রা করলাম।আমি যদি হোস্ট এজেন্সির কথা বলি তাহলে কাস্টমার হিসাবে বলতে বাধ্য যে ফ্লাই ফার লেডিস আমার আগের গ্রূপ ট্যুরের অভিজ্ঞতার থেকে হাজারগুন ভালো। আমার ২০১৮ সালের নেপাল ট্রিপ এর কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয় যে জীবনে আমি বড় কোন পাপ করেছিলাম যে আমার মাথায় ওই গ্রূপে যাওয়ার বুদ্ধি হয়েছিলো। আমার পুরো মিশরের ট্রিপে যদি কোনো বিষয় পরিবর্তনের সুযোগ থাকতো তাহলে আমি অবশ্যই সৌদি এয়ারলাইন্স অন্তত এই ট্রিপে কখনোই নিতাম না। অতি জঘন্য রুট ঢাকা থেকে জেদ্দা এর।এই ৬ ঘন্টা ৪০ মিনিটের ফ্লাইটের প্লেন এর সিট অত্যন্ত ঘিঞ্জি আর বসার পিঠের অংশ প্রচন্ড খাড়া, নেক পিলো বসানোর জায়গা থাকে না, মধ্য রাত ২:৩০শে ঘুম থেকে তুলে শুকনা স্যান্ডউইচ আর গলায় আটকানো কেক আর একটা জুস্ দিলো খেতে যা আমি খাইনি, এর পর খুব ভোরে ডেকে তুলে একটা নাস্তা দিলো যেটা বাধ্য হয়েই খেয়েছি কারণ মাঝে ৩ ঘন্টার ট্রানজিট ছিল জেদ্দায়। জেদ্দার এয়ারপোর্ট টার্মিনালের কথা না বললেই নয়। যদি আপনি ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট দেখে থাকেন এক বিশ্রী মাছের বাজার, এটা হলো বিশেষ করে বাংলাদেশী, ইন্দোনেশিয়ান আর মালয়েশিয়ান ফ্লাইটের যাত্রীদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কারণ এরাই বেশি এখানে আসে ওমরাহ করার জন্য।বসা তো দূরে থাক নিঃশ্বাস নেবার জায়গা নেই টার্মিনালে। আমাদের সৌদি এয়ারলাইনসের জন্য এখানে থামতে হয়েছে নইলে যেই ভবিষ্যতে যান সৌদি এয়ারলাইনসের ঢাকা জেদ্দা না নিয়ে এমিরেটস নিন, ট্রানজিট হবে দুবাই আর অন্তত মানুষের মত প্লেন যাত্রা করতে পারবেন। যাইহোক সকাল ৯:৪০ এর ফ্লাইটে জেদ্দা থেকে কায়রোর উদ্দেশ্যে উড়ে গেলাম সৌদি এয়ারলাইনসে আবার কিন্তু আশ্চর্য হলাম এই রুটের সার্ভিস এবং প্লেন দুইটাই আগেরটার থেকে কিছুটা ভালো।কি দুর্ভাগ্য বাঙালিদের যে একই টাকা পরিশোধ করেও বর্ণবাদ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সকাল ১১টায় ঝকঝকে নীল আকাশ হলুদ বালির দেশের রাজধানী কায়রোতে নামলাম।গ্রূপের হোস্টকে ট্রিপের টাইম সিলেকশনের ক্রেডিট দিতেই হচ্ছে কারণ আমরা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছি। এর চেয়ে চমৎকার আবহাওয়া হতেই পারেনা। ইমিগ্রেশন স্বাভাবিক ছিলো। এদের ইংরেজী বিদ্যা চাইনিজদের থেকে ভালো।দুঃখের বিষয় এয়ারপোর্টে নেমেই স্ক্যামের শিকার হলাম। ফোনের সিমকার্ড এর জন্য ভোডাফোন এর স্টল থেকে একটা ৩০ জিবি প্যাকেজের সিমকার্ড ৫০০ ইজিপশিয়ান পাউন্ডে নিলাম যেহেতু ৭ দিন থাকবো আর আগেই শুনেছি যে এখানকার ইন্টারনেটের অবস্থা করুন তাই সিম কার্ডের ডাটাই ভরসা। যেহেতু ক্যাশ ডলার তখনও ভাঙ্গাইনি তাই ক্রেডিট কার্ডেই নিলাম। এরপর এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হোটেল এ গেলাম কায়রোর ট্র্যাফিক ঠেলতে ঠেলতে। ঢাকার ট্র্যাফিকের সাথে বিশেষ কোনো পার্থক্য পাইনি। একটি মধ্যম বর্গীয় হোটেলে আমরা ছিলাম যদিও তাদের দাবি ছিল তারা ৫ তারা কিন্তু বাস্তবিকে আমি তাদের ৩ তারার বেশি দিতে পারিনি। আমি দুটো মোটামুটি ভালো হোটেলে ছিলাম ইজিপ্টে আর তার কোনোটাতেই রুমে কোনো ওয়াইফাই ছিল না। ওয়াইফাই শুধুমাত্র লবিতে ছিলো। এখন এটা ইজিপ্টের সাধারণ প্র্যাকটিস কিনা জানা নেই তবে আপনারা যারা ভবিষ্যতে বেড়াতে যাবেন জেনে রাখুন ইজিপ্টের ইন্টারনেট সার্ভিস মোটেও ভালো নয়। এবার আসি স্ক্যামের কথায়, আমি এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে ফেরার ঘন্টা দুয়েক পরেই সিমের প্যাকেজ একটিভেট হয়ে যাবার কথা কিন্তু ৩ ঘন্টা পরে আমাকে একটা এরাবিক ভাষায় মেসেজ দিলো যেটা আমি পড়তে পারিনি আর তারপর যা ও বা ডাটা দিয়ে ইন্টারনেট চলছিলো সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু কল চালু ছিল। সন্ধ্যায় আমরা একটা "নাইল বা নীল নদের রিভার ক্রুজ" ডিনারে গেলাম। সেখানে খাওয়া দাওয়া হলো আর লোকাল ফোক ডান্সের সাথে বেলি ডান্সও দেখলাম। খাবার মোটামুটি ছিল তবে নাচ গানের প্রোগ্রাম আরো আকর্ষণীয় আশা করেছিলাম। বেলি ডান্স ছাড়া অন্য পারফরম্যান্স আমার কাছে খুব সাদামাটা লেগেছে। ডিনার থেকে আসার পথে আমাদের লোকাল গাইডকে সেই মোবাইলের মেসেজ দেখলে বললো যে পরের দিন লুক্সোর যাবার সময় রেল স্টেশনের থেকে সিম এ কি হয়েছে ঠিক করিয়ে দেবে। আমাদের হোটেলের নাস্তার আইটেম ভালো ছিল, কন্টিনেন্টাল আর লোকাল দুইই ছিল। ২য় দিন সকালে নাস্তা করে সোজা সাক্কারা পিরামিড দেখতে চলে গেলাম। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো প্রথমবার পিরামিড নিজের চোখে দেখে। গিজার পিরামিড দেখার আগে এটা দেখে নেওয়া ভালো কারণ এখানে অত ভিড় থাকে না। আর এটাই প্রথম স্টেপ পিরামিড তাই এটা লিস্টের প্রথমেই থাকা উচিৎ। তারপর ওখান থেকে মেম্ফিস আর আর্ট মিউজিয়াম।মেম্ফিস হলো পুরাতন নগরী আর সেখান থেকে মিউজিয়ামে পাবেন রামেসিস এর সেই বিরাট মূর্তি। লাঞ্চের পর গেলাম বিখ্যাত গিজার পিরামিড আর স্ফীনক্স দেখতে।অদ্ভুত এই লাইমস্টোনের পিরামিডের দুই রূপ দেখলাম রোদের ঝলকানিতে। পিরামিড দেখতে আসলে বেশি সময় লাগে না। ভালো হয় আপনি যদি গাড়ি বা বাসে করে দেখতে যান কারণ বাস বা গাড়িতে যেখানেই যান পিরামিডের কাছে আপনাকে হেটে যেতে হবে। পায়ে ভালো গ্রিপ ওয়ালা সু থাকা ভালো কারণ আসে পাশে প্রচুর ভাঙা পাথরে হোঁচট খাবার সম্ভাবনা আছে। সাথে ছাতা বা রেইনকোট রাখা ভালো মিশর ভ্রমণে কারণ মরুভূমির মেজাজ মর্জি কিছুই বলা যায় না। আমি গিজাতে যেয়েই হালকা বৃষ্টি আর ধুলি ঝড় পেয়েছিলাম। আপনি চাইলে পিরামিডের ভিতরে যেতে পারেন যদি শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকেন বা ক্লস্ট্রোফোবিক না হন। সন্ধ্যায় এখানে ৪৫ মিনিটের একটা লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয় সেটাও টিকেট কেটে দেখতে পারেন যদি হাতে সময় থাকে। তবে ভালো হয় যেকোনো কিছু দেখার আগে ইউটিউব বা গুগল করে দেখে নেওয়া যে আসলেই আপনি সেটা দেখতে চান কিনা, কারণ এন্ট্রি ফি খুব একটা কম নয় আর সব কিছু যে আপনার ভালোই লাগবে এমন নয়। দিন শেষ হলো ইজিপশিয়ান গোল্ডেন ঈগল পারফিউম এর দোকানে।তারপর সন্ধ্যা ৭:৪০শে ব্যাগ নিয়ে লুক্সরের ট্রেন ধরতে স্টেশনে বেরিয়ে গেলাম।ট্রেনের টিকেট আমরা গাইডের মাধ্যমে কেটে ছিলাম। স্লিপার কোচের টিকেট আপনি যদি লুক্সরের প্ল্যান আগেই করে থাকেন তাহলে কায়রো নেমেই কেটে নেবেন স্টেশন থেকে।লুক্সর এর যাবার স্লিপিং কোচটা সুবিধার ছিল না, নিচের বার্থ খুবই চাপা ছিল আর কেবিনের টেবিল ভাঙা। আমি স্টেশনে যেয়ে ভোডাফোনের দোকান যেয়ে শুনলাম যে আমাকে মাত্র ১১০ পাউন্ড কল করার প্যাকেজ একটিভেট করে দিয়েছিলো এয়ারপোর্ট থেকে ওই ৫০০ পাউন্ড থেকে। তার মানে বাকি টাকা সম্পূর্ণ গচ্চা। বাধ্য হলাম আবার ১০০ পাউন্ড দিয়ে ১০জিবি প্যাকেজ কিনতে। আমি দুটি সত্য এই ট্রিপ শেষ করার আগেই উপলব্ধি করেছি তাই ১ম পর্বেই বলে দিচ্ছি। প্রথম কথা হলো, আপনার যদি দরাদরির ক্ষমতা না থাকে তাহলে এই মিশরীয়রা মিনিটে মিনিটে আপনার পকেট কেটে নেবে আর দ্বিতীয় সত্য হলো মিশরীয়রা প্রচন্ড রকম মিথ্যাবাদী, কসম কেটে মিথ্যা বলবে তাই এদের কোনো কথা বা সাজেশন নেবার চাইতে ভালো হয় আপনি এখানে আসার আগে যেই জায়গায় যাবেন ভালো করে পড়াশুনা করে নিন।বিশেষ করে রাস্তার রুট এবং নির্দিষ্ট দ্রষ্টব্যঃ স্থানের এন্ট্রি ফি।এদের মিষ্টি কথা বা আগ বাড়িয়ে প্রশংসা শুনে এদের বন্ধু মনে করার কারণ নেই, আপনার পকেটে যতক্ষণ টাকা আছে ওরা ততক্ষন আপনাকে শুষে খাবে। তাই আমি গাইড নেয়ার পরামর্শ একদম দেবোনা কারণ এই গাইডরা আপনার বাজেটের ৭০% টাকা খেয়ে ফেলবে শুধু চালাকি করে নিজেদের কমিশনের জন্য। মিশরে একটা আইসক্রিম পর্যন্ত আপানাকে দরাদরি করে কিনতে হবে। আমাকে একটা আইসক্রিম ৫০ পাউন্ড থেকে ২০ পাউন্ডে নামিয়ে আনার জন্য দরাদরি করতে হয়েছে। যদিও সেটার মূল্য আসলে ৫-১০ পাউন্ডের বেশি না কিন্তু আমি বিদেশী বলে আমার গাঁট কাটা ওদের কাছে হালাল। চারিত্রিক ভাবে এরা দক্ষিণ এশিয়ানদের মত অতিথি বৎসল নয়। এরা আপনার খাওয়া শেষ করার আগে বিল ধরিয়ে দেবে এবং খাওয়া শেষ করার সাথে সাথে আপনার রেস্টুরেন্ট ছেড়ে চলে যাওয়াটাই আশা করবে। সেই ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো খাওয়া দাওয়া করুন যেখানে খাবারের মেনু দেবে এবং মেনুতে মূল্য দেয়া আছে। অর্থ্যাৎ ভালো রেস্টুরেন্ট। স্ট্রিট ফুড অবশ্যই খাবেন সেই ক্ষেত্রে আগে দাম জেনে নিন কারণ এরা একেবারে নির্মম টাকা পয়সার ব্যাপারে। মিশরে গেলে আপনি একবার হলেও ঘোড়ার গাড়ি বা উটে চড়তে চাইবেন, মনে রাখবেন ওরা লোকালদের যা দাম চায় আপনার কাছে চাইবে ৩/৪ গুন্ বেশি। ওহ আরেকটা কথা, আপনি মিশরে যতবার টয়লেটে যাবেন আপনাকে ৫-১০ পাউন্ড দিয়ে যেতে হবে। টয়লেটের বাইরেই একজন দাঁড়ানো থাকবে টাকা সংগ্রহের জন্য। এবারের মত এতটুকুই বাকি সব আসছে।


চলবে ~